ঢাকা , শনিবার, ২৯ মার্চ ২০২৫ , ১৫ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ই-পেপার

১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাবনা

আপলোড সময় : ২৬-০৩-২০২৫ ১২:৩৯:২৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২৬-০৩-২০২৫ ১২:৩৯:২৯ অপরাহ্ন
১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাবনা
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ব্যাংক হিসাবে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমার ওপর আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করার সুপারিশ করেছে । আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপলক্ষে অর্থ উপদেষ্টাকে দেওয়া প্রস্তাবনায় এই সুপারিশ করা হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই বাজেট প্রস্তাব লিখিত আকারে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ সময় ইআরএফ প্রেসিডেন্ট দৌলত আক্তার মালাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

ইআরএফের বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়, কর পরিশোধিত আয় থেকে একজন ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে মুনাফার ওপর ১০-১৫ শতাংশ কর কাটা হয়। আবার ব্যাংকের জমা স্থিতির ভিত্তিতে আবগারি শুল্ক কাটা হয়। এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় সক্ষমতা কমেছে। আবার বিভিন্ন ভীতির কারণে অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইছে না। এ রকম অবস্থায় ৫-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমার ওপর আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার এবং মুনাফার ওপর কর কমানো যেতে পারে।

এই প্রস্তাব দেওয়ার পাশাপাশি ইআরএফ থেকে আরও ২৭টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- আগামী অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে ইআরএফ মনে করে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের আগেই ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা জরুরি। কারণ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের একটি ধাক্কা অর্থনীতিতে পড়বে। এ সময় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনীতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আগামী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন বলে ইআরএফ মনে করে।

শুধু সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি ও সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রতাসাধনের মাধ্যমে এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। এ জন্য বাজার ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ চেইনে বিদ্যমান সিন্ডিকেট ভাঙা ও সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধেও সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়সীমা অন্তত ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে দরিদ্রদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সরকার ওপেন মার্কেট সেল বাড়িয়েছে, যা প্রশংসার যোগ্য। এ ধারা আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখা জরুরি। একইসঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতার উপকারভোগী ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করছি।

ইআরএফ থেকে বলা, আমরা লক্ষ করছি যে বিপুল পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ এবং ভর্তুকির চাপে সরকারের পরিচালন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে গত কয়েক বছর ধরে উন্নয়ন ব্যয় বাড়ছে না। তাই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ করে ব্যয় করার ক্ষেত্রে সরকারের আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে ইআরএফ মনে করে।

সংগঠনটি প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার মান সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। সরকারের নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি সাধারণ মধ্যবিত্তরাও এখন বাংলাদেশি স্বাস্থ্যসেবার ওপর আস্থা হারিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য ছুটছেন। এ অবস্থায় দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের প্রত্যেকটিতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের স্ট্যান্ডার্ডে একটি করে হাসপাতাল স্থাপন করতে আগামী বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। ক্যানসারসহ দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ককর প্রত্যাহার করা।

ধারাবাহিকভাবে ওষুধের দাম ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি বাড়ছে যা বহনের ক্ষমতা দেশের বেশিরভাগ মানুষের নেই। বাংলাদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার ৭২ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর দেশের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। ওষুধের দাম ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যয় কেন এত বাড়ছে তা সরকারের খতিয়ে দেখা দরকার। আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার কমিয়ে আনার সুপারিশ করছি।

সরকারের বিভিন্ন সংস্থার জনবলকে এখনও ১-২ টাকা কেজি দরে তেল, চিনি, মসুর ডালসহ বিভিন্ন রেশন পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যদিকে অতি দরিদ্রদের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে বিতরণ করা খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ অবস্থায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির পণ্যমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে রেশন পণ্যের দাম বাড়ানো যেতে পারে।

পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, কারা পুলিশ, জেলার, বিচারকসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করলেও বেতন-ভাতার বাইরেও তারা ঝুঁকিভাতা পাচ্ছেন, যা সরকারের অন্যান্য সংস্থায় কর্মরতদের সঙ্গে আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এ ধরনের ঝুঁকিভাতা প্রত্যাহার করা যেতে পারে।

ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে গতি নেই। ফলে বর্ধিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বিভিন্ন শিল্প-কারখানা বন্ধের কারণে উল্টো লাখো শ্রমিক বেকার হয়েছে। কর্মসংস্থান ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে বাজেটে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

অন্তবর্তী সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কোন খাতে কোন ধরনের সংস্কার হবে, তার প্রভাব অর্থনীতি ও জনজীবনে কতটা পড়বে সে সম্পর্কে কেউ ধারণা করতে পারছেন না। তাই সরকার তার মেয়াদে কোন কোন সংস্কার করতে আগ্রহী এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব কী হবে, তা বাজেট বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।

মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষাকে সহজলভ্য এবং যথাসম্ভব সাশ্রয়ী করতে হবে। দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বিদেশি বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। অন্যদিকে দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশিরা চাকরি পাচ্ছে না। প্রয়োজনে পিপিপির মাধ্যমে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে মিডলেবেল ম্যানেজমেন্টের উপযোগী জনবলকে দক্ষ করে তুলতে হবে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে আসন সংখ্যা বাড়াতে হবে। আসন সংকটের কারণে এইচএসসি পাস করে অনেকেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ভর্তি হতে পারে না। আবার তাদের অনেকের পক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় তারা ঝরে পড়ছে।

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন সামনে রেখে রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যেহেতু বেশিদিন রফতানিতে ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হবে না, তাই সম্ভাবনাময় পণ্যগুলোকে প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে প্রমোট করে রফতানি উৎসাহিত করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন সামনে রেখে বেসরকারি খাতের সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দসহ কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রেডিকটেবল রাজস্বনীতি ঘোষণা করার পাশাপাশি ব্যবসার পরিবেশ সহজ করার ওপর জোর দিতে হবে।

উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এসএমই খাতকে সরকারের বিভিন্ন কাগুজে নীতিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হলেও বাজেটে এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হয় না। তাই এসএমই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করছি।

ইধারএফের প্রস্তাবনার মধ্যে আরও আছে- অনিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, শিক্ষা ও চিকিৎসা উপকরণে কর হার ৫.০ শতাংশে সীমিত রাখা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশে পৃথক রাজস্বনীতি প্রণয়ন। বন্ড সুবিধা যাতে তারা সহজে পান। বেসরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডকে করমুক্ত রাখা। ভ্যাটের হার ৭ করা। বাজার মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পদ কর আদায়। পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইনসহ মিডিয়ার কর হার কমিয়ে আনা। কাস্টমসের টাইম রিলিজ স্টাডির মতো আয়কর ও ভ্যাটেও একই রকম স্টাডি করা।

কর ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। প্রতি করছাড়ের আদেশের সঙ্গে কত রাজস্ব ক্ষতি হলো তার একটা প্রাক্কলন দেওয়া।

এ ছাড়া এনবিআরের যেকোনো পলিসি ডিসিশনের ইমপ্যাক্ট অ্যানালাইসিস হওয়া উচিত যার ভিত্তিতে পরবর্তীতে ডিসিশন নেওয়া সম্ভব হবে। ট্যাক্স, ভ্যাট ও শুল্কছাড়ের সুফল কাদের পকেটে যায়, তার নির্মোহ বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। একটি ইফেক্টিভ ফিসক্যাল পলিসির জন্য এই গবেষণা ও বিশ্লেষণ খুবই প্রয়োজন, যে প্রস্তাব অতীতেও ইআরএফ এর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। সরকারের অন্যান্য দফতরের সমন্বয়ে কিংবা ইআরএফের সহায়তায় এই বিষয়ে গবেষণা করা উচিত।

সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ বলেন, এনবিআরে রিটার্ন জমা এবং ঋণ নেওয়ার সময় ব্যাংকের কাছে দেওয়া সম্পদ বিবরণীর তথ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। এখন ড্রাইভার, দারোয়ান, অফিস সহায়কসহ বিভিন্নজনের নামে অনেকে ব্যবসা দেখিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ বের করে নিচ্ছে। বেনামি এই ঋণ আর আদায় হয় না। এ ক্ষেত্রে বড় ঋণ অনুমোদনের আগে এনবিআরের নির্দিষ্ট ডাটাবেজ থেকে ব্যবসায়িক তথ্য নেওয়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এতে ঋণ জালিয়াতি কমবে। আবার রাজস্ব আদায় বাড়বে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : mainadmin

কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ